আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আসেন তালেবান নেতারা । সবচেয়ে বেশি সংখ্যা ছিল যে বিষয়টি নিয়ে সেই নারী অধিকারের বিষয়ে শরিয়া আইন মানার ঘোষণা দিয়েছে । তালেবান মিশরী নারী অধিকার দেয়া হবে । ইসলামিক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেন অভ্যন্তরীণ কোনো শত্রু তারা চান না। তারা চান আর না হোক যারা দেশ ছেড়ে পালাতে চাচ্ছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
এগিয়ে চলেছে তালেবান
তালেবানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। অগাস্ট মাসে তারা বেশ কিছু বড় বড় শহরের কেন্দ্রে আক্রমণ করেছে। আঞ্চলিক রাজধানীগুলোর এক তৃতীয়াংশ এখন তাদের দখলে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরের কুন্দুজ এবং তাখার প্রদেশের তালোকান।
এসপ্তাহে তারা দখল করে নিয়েছে পশ্চিমের হেরাত, দক্ষিণের কান্দাহার এবং লশকর গাহ। কৌশলগত দিক ছাড়াও প্রতীকীভাবেও এসব শহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে দশ লাখেরও বেশি মানুষের বাস।
মার্কিন বিমান বাহিনীর সহযোগিতায় আফগান সামরিক বাহিনী তালেবানের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত দেশটিতে যেসব বিদেশি সৈন্য রয়ে গেছে, ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারাও চলে যাবে।
কুড়ি বছর আগে এই দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা করেছিল আল-কায়দা। এর পরেই শুরু হয় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান যাতে তালেবান সরকারের পতন ঘটে। এই তালেবান ওসামা বিন লাদেনসহ আল-কায়দার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
দীর্ঘ দিনের এই যুদ্ধে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। বাড়ি ঘর থেকে পালিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। দেশটির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে যেসব জায়গায় এখন তালেবান শাসন করছে, সেসব স্থানে
সামাজিক বিধি-নিষেধ
নারীর ওপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ এই প্রথমবারের মতো নেমে এলো আফগান দাই নূরিয়া হায়ার জীবনেও।
“অনেক বিধি-নিষেধ। বাড়ির বাইরে গেলে আমাকে বুরকা পরতে হয়। তালেবান আমাদেরকে এটা পরার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়াও এসময় আমাদের সাথে একজন পুরুষও থাকতে হয়,” বলেন তিনি।
আরো পড়তে পারেন:
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে একটু একটু করে ‘পরাজিত’ হলো যুদ্ধ অবসানের জন্য আলোচনা চলছে, বললেন আফগান প্রেসিডেন্ট কাবুলে ‘সায়গনের’ পুনরাবৃত্তি? নাগরিকদের উদ্ধারে সৈন্য পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন কাবুলে শরণার্থীর ঢল, প্রতিবেশী দেশগুলোকে সীমান্ত খুলে দিতে জাতিসংঘের আহ্বান এর ফলে একজন দাই হিসেবে পুরো এলাকায় চলাচল করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরুষের দাড়ি কামানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
তালেবান বলছে এটা ইসলামবিরোধী। বিদেশিদের মতো করে মাথার পেছনে ও দুপাশে ছোট করে চুল কাটার স্টাইলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তালেবানের ভেতরে ‘আমরি বিল মারোফ’ নামের একটি গ্রুপ বিভিন্ন সামাজিক নিয়ম বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এই নামের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহর নির্দেশ।’ ১৯৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে যেসব ভয়াবহ ধরনের শাস্তি দিতে হতো – এই গ্রুপটি সেই ভীতিকর পরিস্থিতি ফিরিয়ে এনেছে। এই গ্রুপটি এখন আবার দুই স্তরের শাস্তির প্রচলন শুরু করেছে- প্রথমে সতর্ক করে দেওয়া এবং তারপরে শাস্তি। এসব শাস্তির মধ্যে রয়েছে প্রকাশ্যে অবমাননা, কারাদণ্ড, প্রহার, বেত্রাঘাত, চাবুক মারা ইত্যাদি।
“হঠাৎ করেই আমাদের বেশিরভাগ স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটা খুব কঠিন। কিন্তু আমাদের তো আর কোনো বিকল্প নেই। তারা নিষ্ঠুর। তারা যা বলবে সেটাই আমাদের করতে হবে। তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা ইসলামকে ব্যবহার করছে। আমরাও তো মুসলিম। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ভিন্ন,” বলেন নূরিয়া হায়া। এসবের পাশাপাশি অপরাধ-জনিত ব্যাপারে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় লোকজন এই পরিবর্তনের ব্যাপারে খুশি, যদিও তারা এই অবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে সেবিষয়ে নিশ্চিত নন।
উপার্জন বন্ধ
আরো অনেক জিনিসও বন্ধ হয়ে গেছে। আফগানরা তাখার প্রদেশে বেড়াতে আসতেন। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে তাখার খুব বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে। পাহাড়ি নির্মল বাতাস, তুষারে আবৃত পর্বতমালা, বিস্তৃত শ্যামলিমা, সবুজ গাছপালা এবং বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানির নদী দেখতে অনেকেই বেড়াতে আসতেন এই প্রদেশে।
একজন ট্যাক্সি চালক।
ফারখার জেলায় একজন ট্যাক্সি চালক আসিফ আহাদি বলেন গাড়ি চালিয়ে তিনি একদিনে ৯০০ আফগানি (১১ ডলার) আয় করতেন। কিন্তু তালেবানের অগ্রযাত্রার কারণে পর্যটকদের বেড়াতে আসাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ড্রাইভার আসিফ, ৩৫, বলেন, “এই পর্যটকরা ছিল আমার খদ্দের। তাদের কাছ থেকে যে অর্থ পেতাম সেটা দিয়ে পরিবারের জন্য খাবার কিনতাম। এখন সর্বোচ্চ আয় করলেও একদিনে আমি ১৫০ আফগানি রোজগার করতে পারি। এই অর্থ দিয়ে গাড়ির তেলের খরচও ওঠে না। তেলের দাম বেড়ে এখন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।”
সামাজিক জীবনেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
লোকজন আগে প্রত্যেক শুক্রবার রাতে পার্টি করতো। গান বাজনা নাচ হতো। মজা করতো। এখন তো এসব কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে,” বলেন আসিফ।
বন্ধ ব্যবসা বাণিজ্য
সব ব্যবসা বাণিজ্যেই একই ধরনের ক্ষতি হয়েছে।
আফগানিস্তানের বৃহত্তম বিমানঘাঁটি বাগরাম থেকে মার্কিন ও নেটোর সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার দু’দিন পর, ৪ঠা জুলাই, তালেবান বাহিনী কান্দাহার প্রদেশের পাঞ্জোয়া জেলা দেখল করে নেয়। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বাহিনীর অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাগরাম বিমানঘাঁটি।
এর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে তারা ইরানের সাথে দেশটির সবচেয়ে বড় সীমান্ত চৌকি ও বাণিজ্য পথে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। দখল করে নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর – ইসলাম কালা।
মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তালেবান বাহিনী দাবি করে যে তারা আফগানিস্তান সীমান্তের ৯০% এবং দেশের ৮০% এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই দাবির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে আফগান সরকার। তবে কোন পক্ষের দাবি সঠিক – সেটি যাচাই করা খুব কঠিন।
তালেবান যোদ্ধা।
ছবির উৎস,AFP
ছবির ক্যাপশান,
একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে তালেবান যোদ্ধারা।
তালেবান যতোই তাদের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করতে থাকে, ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লোকজন ততই বাইরে বের হয়ে আসতে শুরু করে, বলেন ট্যাক্সি চালক আসিফ।
তালেবান যতো দ্রুত কোনো একটি ঘটনার বিচার করে এবং যে প্রক্রিয়ায় সবকিছু পরিচালনা করে অনেকেই সেসব আগে কখনো দেখেনি।
আরো পড়তে পারেন:
অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে তালেবানের আফগানিস্তান কব্জা, তাদের শক্তির উৎস কী
বিশ বছর পর আফগানিস্তানে তালেবান যেভাবে শাসন করছে
আফগানিস্তানে কেন যুদ্ধ চলছে?
তালেবান কারা, আফগানিস্তানে কীভাবে তাদের উত্থান ঘটেছিল?
“অপরাধের মতো কোনো বিষয়ে তারা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে কোনো আমলাতন্ত্র নেই। লাল ফিতা নেই। মাত্র কয়েক দিনেই সব ধরনের সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এবং কেউ কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না,” বলেন আসিফ।
যাকাতের অর্থও সংগ্রহ করছে তালেবানের যোদ্ধারা। দরিদ্র মানুষের জন্য লোকেরা তাদের সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ যাকাত হিসেবে দান করে থাকে। কিন্তু তালেবান এই অর্থকে কর হিসেবে দেখিয়ে তাদের নিজেদের জন্য ব্যবহার করছে।
আসিফ বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এটাও একটা আর্থিক চাপ। “সব জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে,” বলেন আসিফ। বাইরের ও ভেতরের সব ধরনের বাণিজ্যই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংকুচিত হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। সরকারি কাজও বন্ধ হয়ে গেছে।
“লোকজন ইতোমধ্যেই গরিব হয়ে পড়েছে। তাদের কাজের কোনো সুযোগ নেই। নেই কোনো বিনিয়োগও,” বলেন তিনি।
তবে কেউ কেউ আছেন যারা আগে তালেবানকে দেশ পরিচালনা করতে দেখেছেন।
“তাদের আদর্শ এবং চিন্তা ভাবনা ঠিক আগের মতোই আছে, যেসময় তারা ক্ষমতায় ছিল। কিছুই পরিবর্তন হয়নি,” বলেন জান।
তিনি জানান তালেবান তার এলাকায় সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের কথা হলো- কঠোর ইসলামিক শরিয়া আইনের বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা অনুসারে শিক্ষা দিতে হবে।
এবিষয়ে স্থানীয়দের অনেকেই উদ্বিগ্ন।
আফগানিস্তানের মানচিত্র।
তালেবান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন থাকার সময় নারীদের শিক্ষা ও কাজ নিষিদ্ধ করেছিল। এমনকি তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবাও সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল।
তাদেরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে নারীরা আবার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ সদস্যও নারী।
প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছায়। তবে মাধ্যমিক স্কুলে এই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ শতাংশ। নারীর গড় আয়ু ৫৭ থেকে বেড়ে হয় ৬৬ বছর।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এসব সংখ্যা খুব বেশি না হলেও গত দুই দশকে দেশটিতে কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এখন এসব আবার পেছনের দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।