কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২-২৩ বছরে এক বিস্ময়কর কাব্য প্রতিভা নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। নজরুল জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বা ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বাংলা সনে। আর ১৯২২ সনে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশ পায়। এ সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৩ বছর। অগ্নিবীণাতে ২২-২৩টি কবিতা রয়েছে। এ গ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ হয়ে ছিল ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে।
কাজী নজরুল ইসলাম
আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হানত্ সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান– আসবে তখন পান’। হয়ত তখন আমার কোলে সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে, আপনি সেদিন সেধে কেঁদে চাপবে বুকে বাহু বেঁধে, চরণ চুমে পূজবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে!
কাজী নজরুল ইসলাম
আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে, সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে- দুলবে তরী রঙ্গে, প’ড়বে মনে সে কোন্ রাতে এক তরীতে ছিলেম সাথে, এমনি গাঙ ছিল জোয়ার, নদীর দু’ধার এমনি আঁধার তেমনি তরী ছুটবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে!
কাজী নজরুল ইসলাম
তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ, আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ- সখার কারা-বন্ধ! বন্ধু তোমার হানবে হেলা ভাঙবে তোমার সুখের মেলা; দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর, বইতে প্রাণের শান- এ ভার মরণ-সনে বুঝ্বে- বুঝবে সেদিন বুঝবে!
কাজী নজরুল ইসলাম
আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন, কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন- টুটবে যবে বন্ধন! পড়বে মনে, নেই সে সাথে বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে- আপনি গালে যাচবে চুমা, চাইবে আদর, মাগবে ছোঁওয়া, আপনি যেচে চুমবে- বুঝবে সেদিন বুঝবে।
কাজী নজরুল ইসলাম
মাঝে মাঝে আমাদের অনেকেই অনেক বেশি আবেগ প্রবন হয়ে যাই। তখন ফেসবুকে ইমোশনাল উক্তি ও বাণী পোষ্ট করে থাকেন। তাই যারা ইমোশনাল উক্তি ও বাণী পেতে চান। তাদের মনের ভাবনা পূরণ করতে আমরা উল্লেখ করেছি ইমোশনাল উক্তি ও বাণী। এখান থেকে সংগ্রহ করে নিন ইমোশনাল উক্তি ও বাণী।
যেভাবে লেখা হয়েছিল বিদ্রোহী কবিতাটি
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ”বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে।”
”পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ”বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”

কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে মুজফফর আহমদ এরপর বর্ণনা দিয়েছেন, যেহেতু তিনি সামনাসামনি কারো প্রশংসা করতে পারেন না, তাই কবিতা শোনার পরেও তিনি উচ্ছ্বসিত হতে পারেননি। তাতে মনে মনে কাজী নজরুল ইসলাম আহত হয়েছিলেন বলেও তার মনে হয়েছে।
”আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাত্রে কবিতাটি লিখেছিল, তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।….এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।” লিখেছেন মি. আহমদ।
সেদিন বেলা হওয়ার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়িতে আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সেটা শুনে একটি কপি সঙ্গে নিয়ে যান।
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”আমিও বাইরে চলে যাই। তারপরে বাড়িতে ফিরে আসি বারোটার কিছু আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, বিজলীতে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।”
বিদ্রোহী কবিতাটি ১৩৯-পঙক্তির।
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল।
তার ধারণা, মোসলেম ভারতের কার্তিক সংখ্যায় পরবর্তীতে সেটা ছাপা হলেও সেই সংখ্যাটি বের হয়েছিল ফাল্গুন মাসে।
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।”

ছবির উৎস,NAZRUL ACADEMY
‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে মোহিতলালের ‘ভাব চুরির’ দাবি
মুজফফর আহমদ তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেছিলেন যে, তার ‘আমি’ শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে কবিতাটি লিখেছে, কিন্তু কোন ঋণ স্বীকার করেনি। এই প্রচারটি তিনি মৌখিকভাবে করেছিলেন।
কারণ এর বছরখানেক আগে একটি সাহিত্য আসরে মানসী পত্রিকা থেকে ‘আমি’ নামের নিজের লেখা একটি গদ্য পড়ে শুনিয়েছিলেন মোহিতলাল মজুমদার, যে আসরে মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই ছিলেন।
কিন্তু সেই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন মি. আহমদ। তবে তিনি এও উল্লেখ করেছেন, ”……একবার মাত্র শুনে এত দীর্ঘকাল পরে সে ‘আমি’র ভাবসম্পদ নিয়ে বা চুরি করে যে বিদ্রোহী রচনা করেছিল, আমি তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে।……এটা আমি মানতে রাজী আছি, মোহিতলালকে লেখাটি পড়তে শুনে তার মনে হয়তো একথাটা আসতে পারে যে, এই ধরনের একটা কবিতা লেখা যায়।”
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বিংশ শতাব্দী’-তে লিখেছেন, মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধের ভাববস্তুর সঙ্গে নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কবিতার রচনার বেশ কয়েক বছর আগে মোহিতলালের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। মোহিতলাল মনে করেন, “তার রচনাকেই নজরুল আত্মসাৎ করেছেন, অথচ কোথাও তার উল্লেখ মাত্র নেই। বলা বাহুল্য, আমি প্রবন্ধের বীজ ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে গ্রন্থটি থেকে গৃহীত, আধ্যাত্মিক রূপকার্থের মূল্যেই সেটি উল্লেখ্য, সাহিত্যগুণে নয়। পরন্তু নজরুলের কবিতাটি যে একান্ত আত্মগত প্রেরণার ফল, তা কাব্যরসিক মাত্রেই স্বীকার করবেন। নতুবা রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্যাহ্ন দীপ্তিতে বিরাজমান, তখনই নজরুলের আকস্মিক আবির্ভাব দলগোষ্ঠী নির্বিশেষে এমন সম্বর্ধিত হত না।”
বিদ্রোহী কবিতার ব্যাঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলে, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্যারোডি করে লিখেছিলেন, ‘আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/ আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।”

ছবির উৎস,NAZRUL ACADEMY