কৈশোরেই বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র-রাজনীতিতে। কলকাতায় যখন যান ইসলামিয়া কলেজে পড়তে, তখনো জড়িয়ে পড়েন ছাত্র-রাজনীতি ও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাজনীতিতেই ছিলেন। উপমহাদেশের এমন মানুষের সংখ্যা কম, যিনি স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতিতে অবগাহন করেছেন।
এখানে আমি বঙ্গবন্ধুর কৈশোরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, কলকাতার ছাত্র-রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা পর্যন্ত আলোচনা করেছি। এক হিসেবে বলা যায়, ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এ-প্রবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ হাসিনা-সম্পাদিত সিক্রেট ডকুমেন্টস [বিবরণে শুধু প্রতিবেদন], আবুল হাশিমের ইনস্ট্রপেকশন [বিবরণে শুধু আবুল হাশিম]।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে জন্ম থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনকথা লিখেছেন। কৈশোরের স্মৃতিচারণায় গ্রাম ও পরিবেশের কিছু বর্ণনা আছে। পরিবারের বর্ণনা তেমন নেই। মূলত ছাত্র-রাজনীতি থেকে তিনি কীভাবে রাজনীতিতে এলেন এবং পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন তার বর্ণনাই বেশি।গোয়েন্দা দফতরের প্রতিবেদনগুলোতেও স্বাভাবিকভাবে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথাই এসেছে। এ-প্রবন্ধে আমি তাঁর রাজনৈতিক জীবনই পুনর্গঠন করতে চেয়েছি, এর বেশি কিছু নয়।
১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে প্রথম বঙ্গবন্ধুর জীবনেতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাই। এই প্রতিবেদনে তাঁর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছিল টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর। ঢাকার ঠিকানা ১৫০ মোগলটুলি, ঢাকা। এখানে মূলত ১৯৪৭-৪৮, বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে কবে কখন খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরোধিতা করেছেন তার উল্লেখ আছে।
১৯৪৯ সালের ১ মে ডিআইবির সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেন।এখানে তাঁর পিতার নাম মৌলভী শেখ লুৎফর রহমান, টুঙ্গিপাড়া, ডাকঘর-পাটগাতী, থানা-গোপালগঞ্জ, জেলা-ফরিদপুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পুরো নাম উল্লেখ করে জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের এলএলবির ছাত্র। তাঁরা চার বোন ও দুই ভাই। ১৯৪৮ সালের পুলিশ প্রতিবেদনে এ-সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে, যা তাঁর আত্মজীবনীতে নেই।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ‘হিস্ট্রি শিট’ অনুযায়ী তাঁর বোন তিনজন, ১৯৪৯ সালের জবানবন্দি অনুযায়ী চারজন। এঁরা হলেন – ফাতেমা বেগম, আসিয়া বেগম, আমেনা বেগম ও লায়লা বেগম। হিস্ট্রি শিটে তাঁর তিন বোনের স্বামীদের উল্লেখ আছে, কিন্তু কে কোন বোনের স্বামী তার উল্লেখ নেই। যে তিনজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা হলেন –
- ১. মৌলভী সৈয়দ হুসাইন এমএ বিএসসি, বেঙ্গল এক্সসাইজের ইন্সপেক্টর, রাজশাহী [গ্রাম : পারুলিয়া, পো : অ. কাশিয়ানী, জেলা ফরিদপুর]।
- ২. মৌলভী নুরুল হক বিএ; প্রধান কেরানি, এজি, পূর্ববঙ্গ, ঢাকা [গ্রাম টুঙ্গিপাড়া]
- ৩. আবদুর রব [আবদুল খালেকের পুত্র, সরাইল, গৌরনদী, বরিশাল] সিভিল সাপ্লাইয়ের ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রাক্টর।
এ-কথা মুজিব শুধু মনে রাখেনইনি বিশ্বাস করেছেন, যে-কারণে রাজনীতিতে তিনি সফল হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটি বিবরণ দিয়েছিলেন ডিআইবির সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে। তার সংক্ষিপ্ত একটি রূপরেখা দিচ্ছি –
১. ১৯৩৭-১৯৩৯ : সাধারণ সম্পাদক, মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর।
- ২. ১৯৩৯-১৯৪২ : প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ, গোপালগঞ্জ।
- ৩. ১৯৪২-১৯৪৩ : সম্পাদক, মুসলিম লীগ প্রতিরক্ষা কমিটি, গোপালগঞ্জ।
- ৪. ১৯৪০-১৯৪৭ : মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠন।
- ৫. ১৯৪৩-১৯৪৪ : বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ত্রাণ কমিটিতে সম্পাদক। মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর সহকারী
- ৬. নাটোর এবং বালুরঘাটে এ কে ফজলুল হক ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের হয়ে প্রচার। গোপালগঞ্জে পাকিস্তান
সম্মেলনের জন্য যে-অভ্যর্থনা কমিটি হয় তার সভাপত
৭. ১৯৪৪ : কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে মুসলিম লীগের হয়ে কাজ।
৮. ১৯৪৫-১৯৪৬ : ফরিদপুর জেলা নির্বাচন ও প্রচার অফিসের ‘ওয়ার্কার ইন চার্জ’। ছয়টি জেলা ছিল এই অফিসের অধীন।
৯. দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে ডেলিগেট হিসেবে যোগদান।
১০. ১৯৪৬ : দিল্লিতে মুসলিম লীগের বিশেষ সম্মেলনে যোগদান এবং কায়েদে আজমের সামনে পাকিস্তানের জন্য আত্মত্যাগের শপথ _ [I took oath to give my life for the achievement of Pakistan in front of Quide-e-Azam].
১১. ১৯৪৬ : বিহারে দাঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ শিবিরে মুসলিম লীগের প্রতিনিধি। তিন মাস, আসানসোল, কারলিয়া, মাদাইগঞ্জ, মায়েরা, নিগা প্রভৃতি এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে সহায়তা।
১২. ১৯৪৬ : কলকাতা দাঙ্গায় কলকাতা মুসলিম ছাত্রলীগের প্রধান হিসেবে ব্রাবোর্ন কলেজে কাজ।
১৩. ১৯৪৬-১৯৪৮ : বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর।
১৪.১৯৩৮-১৯৪৭ : সর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য।
১৫. ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে সিলেট গণভোটে কাজ; পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে কাজ।
১৬. ১৯৪৭-এর পর – তিনি আরো জানিয়েছেন, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন ছাত্রের শাস্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগদান।
১৯. ১৯৪৯ : সালে ৪.১০ মিনিটে আরো ছয়জন ছাত্রের সঙ্গে গ্রেফতার।