আন্তর্জাতিক সংবাদ

আফগানিস্তানকে সাহায্যের অঙ্গীকার ইউরোপের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা নেতাদের !

আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা বাড়াতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আহ্বান জানিয়েছিলেন জি৭ এবং ইউরোপীয় নেতারা। তবে বাইডেন সেই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই খারিজ করে দেন। কাবুলে ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার অভিযান শেষ করতে হবে বলে তালেবানদের জোর দাবি সত্ত্বেও তারা মার্কিন বাহিনীকে কাবুল বিমানবন্দরে বেশিদিন সেনা রাখার জন্য আবেদন করেছিল। তবে বাইডেন রাজি না হওয়ায় মার্কিন সমর্থন ছাড়াই, ওয়াশিংটনের মিত্ররা জনগণকে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং পিছিয়ে থাকা আফগানদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারা ইতিমধ্যে স্বীকার করেছে যে…

তালেবানদের নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে জি৭

গত জুন মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে যখন ধনী দেশগুলোর ক্লাব জি৭ মিলিত হয়েছিল, তখন আফগানিস্তান নিয়ে তাদের বক্তব্য একটি ২৫-পৃষ্ঠার নথিতে সীমাবদ্ধ ছিল। সেখানে মূলত তিনটি কথা বলা হয়েছিলো। নেতারা একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সমঝোতা’ দাবি এবং আফগান সরকারের প্রতি সমর্থন বজায় রাখার জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। দুই মাস পরে সেই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং আমেরিকার ৩১ আগস্টের স্ব-আরোপিত সময়সীমার আগে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নাগরিক এবং মিত্রদের কাবুল থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য হিমশিম খাচ্ছে।

২৪ আগস্ট, সময়সীমার শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, জি৭ নেতাদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক ডেকেছিলেন। বর্তমানে যার সভাপতিত্বে রয়েছে ব্রিটেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস, ন্যাটোর নেতৃত্বদানকারী জেনস স্টলটেনবার্গ এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন। জনসনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সময়সীমা বাড়ানোর জন্য রাজি করা, প্রত্যাহারের জন্য আরও সময় দেয়া। তবে তাকে হতাশ হতে হয়, বাইডেন সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। এর একটি আংশিক কারণ তালেবান ইতোমধ্যেই সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে এটিকে একটি ‘রেড লাইন’ বলে ঘোষণা করেছিল।

ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস ২৪ আগস্ট স্বীকার করেছেন যে, তালেবানরা ‘ইচ্ছা করলে প্রত্যাহার অভিযানকে অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন করে তুলতে পারে’। উদাহরণস্বরূপ তারা বিমানবন্দরে প্রবেশ সীমাবদ্ধ বা রানওয়েতে আক্রমণ করতে পারে। আরেকটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ছিল ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় শাখার হুমকি, যারা তালেবান বিরোধী এবং বারবার কাবুলে হামলা চালিয়েছে। যদিও বাইডেন বৈঠকের পর বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজনে সময়সীমা সামঞ্জস্য করার জন্য ‘বিকল্প পরিকল্পনাও’ রেখেছেন। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনের অপারেশন আমাদের সৈন্যদের জন্য অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে আসে।’ তিনি একটি জনবহুল বিমানবন্দর এবং তার আশেপাশে সন্ত্রাসী হামলা বা তালেবানের সাথে মুখোমুখি হওয়ার বিপদের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে ইতিমধ্যেই ২০ জন আফগান গুলি ও পদদলিত হয়ে মারা গেছেন।

বাইডেনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ৩১ আগস্টের মধ্যে চলে যাওয়ার জন্য, আমেরিকান বাহিনী ২৭ আগস্ট থেকে সব গোছাতে শুরু করবে। যাতে সাহায্যকারী ৫০০ এরও বেশি আফগান কমান্ডোসহ সৈন্য ও সরঞ্জাম বের করে আনার পর্যাপ্ত সময় নিশ্চিত করা যায়। প্রত্যাহার অভিযানে গতিও আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাইডেন জানিয়েছেন, ১৪ আগস্টের পর থেকে ৭০ হাজার ৭০০ জনকে আফগান রাজধানী থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে শেষ ১২ ঘন্টায় ১২ হাজার সেনা এবং আফগান সহযোগীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

কাবুল বিমানবন্দরে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক দেশের থেকে আসা একত্রিত বিশেষ বাহিনীর সেনা রয়েছে। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকা চলে যাওয়ার পর বিমানে করে সরিয়ে আনার এই অভিযানই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা বলে মনে করা হয়। যেটা প্রায় প্রত্যেক বিদেশিকেই দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট হতে পারে (যদিও আমেরিকা স্বীকার করেছে যে তার নাগরিকদের মধ্যে কতজন আফগানিস্তানে আছে, সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নয়)। তবে দুই দশকের যুদ্ধে তাদের সাথে দোভাষী, চালক এবং প্রহরী হিসেবে কাজ করা আফগানদের উদ্ধার করার সময় তাদের অবশ্যই হবে না। ওয়ালেস এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস দুজনেই স্বীকার করেছেন যে, অনেক আফগান মিত্র দেশ থেকে বের হতে বাণিজ্যিক ফ্লাইট খুঁজতে বাধ্য হবে।

তাদের চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে কিনা তা অন্য বিষয়। আমেরিকা এবং ইউরোপ ইতোমধ্যেই তালেবানদের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছে যাতে নিশ্চিত করা যায় যে, প্রত্যাহার নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যেতে পারে। কিন্তু একবার বিদেশী সেনা চলে গেলে, তালেবানরা এই সুবিধাটি দখল করে নেবে এবং সমস্ত প্রস্থান পথের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। তারা এরই মধ্যে তাদের দৃঢ়তা দেখাতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার তালেবানের একজন মুখপাত্র অভিযোগ করেছিলেন যে, আমেরিকা ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য শিক্ষিত পেশাজীবীদের চলে যেতে উৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, এখন থেকে কেবল বিদেশী নাগরিকদেরই বিমানবন্দরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। ‘আমরা আফগানদের দেশ ছাড়ার পক্ষে নই। আমাদের তাদের দক্ষতা দরকার।’

এটি একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। শীর্ষ সম্মেলনের পর জনসন বলেছিলেন, জি৭ তালেবানদের সাথে সম্পৃক্ততার জন্য একটি ‘যৌথ পদ্ধতি’ এবং ‘রোডম্যাপ’ নিয়ে সম্মত হয়েছে। এর বিশাল সুবিধা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি নিউইয়র্কে আটকে দেয়া আফগানিস্তানের প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক রিজার্ভের দিকে ইঙ্গিত করেন। যদিও জি৭ এর যৌথ বিবৃতিতে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়েছে- মানবাধিকার, নারীর অধিকার এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার। তবে জনসনের মতে তাদের জন্য ‘প্রথম শর্ত’ হচ্ছে ৩১ আগষ্টের পরেও দেশ ত্যাগে ইচ্ছুক আফগানদের জন্য ‘নিরাপদ পথ’ খোলা রাখা। ভন ডার লেয়েন মহিলা শিক্ষক, বিচারক এবং আইনজীবী সহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের জন্য ‘নিরাপদ পথ’ এর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।

অপরদিকে, আফগানিস্তানের উপরে জি৭ এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। গত বছর, তাদের দেয়া সাহায্যের পরিমাণ ছিল আফগানিস্তানের জিডিপির দুই-পঞ্চমাংশের বেশি। বাস্তবে যদিও, তালেবানের নগদ প্রবাহ অনুমানের চেয়ে কম হতে পারে। চলতি মাসে লন্ডনের একটি থিংক ট্যাঙ্ক ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, শুধুমাত্র একটি সীমান্ত শহর, জারঞ্জের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন থেকেই সরকারী হিসাবেই রাজস্ব আয় হয় বছরে প্রায় ১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাস্তবে যা আরও বেশি হতে পারে। তালেবানরা এখন এরকম প্রতিটি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিবেদনের সহ-লেখক এবং আফগানিস্তানের বিশেষজ্ঞ গ্রায়েম স্মিথ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে তাদের ধারণার চেয়ে কম সুবিধা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব নিজেকে বোকা বানাচ্ছে যে তালেবান নেতৃত্ব নিষেধাজ্ঞার কারণে পঙ্গু হতে পারে।’

যদিও জনসন বা জি৭ এর বিবৃতিতে তালেবানদের উপর আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি, তবে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে কূটনীতিকরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তারা আরেকটি সমস্যা উপলব্ধি করেছেন। এর ফলে সাধারণ আফগানদের জন্য মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের সেক্রেটারি-জেনারেল জন এগেল্যান্ড বলেন, ‘মানবিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে চলে গেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন যে, সংঘাত, খরা এবং মহামারী ইতিমধ্যেই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে; দূরবর্তী এলাকা থেকে কাবুলে শরণার্থীদের বিপুল প্রবাহ সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি নামে একটি এনজিওর মতে, গত দুই সপ্তাহে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের রিচার্ড গোয়ান বলেন, ‘জি৭ আফগান অর্থনীতির পতনকে ত্বরান্বিত করতে তাদের আর্থিক প্রভাব ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক পতনের ফলে সেখানে আরো সহিংসতা এবং আরো শরণার্থী বাড়তে পারে। যা ইউরোপীয়রা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। এ কারণে ক্লাবের সাত সদস্যই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। উদাহরণস্বরূপ, তালেবান নেতাদের উপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ক্ষমতা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হাতে রয়েছে, যার বর্তমান সভাপতি ভারত। তবুও জি৭ এর বিপরীতে, কাউন্সিলে রাশিয়া এবং চীন অন্তর্ভুক্ত, উভয়ই স্থায়ী সদস্য হিসাবে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। সেখানে যে কোন সমাধান অবশ্যই উভয় দেশকে সন্তুষ্ট করতে হবে, যাদের নাগরিক আফগানিস্তানে কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তালেবানদের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক এবং চীনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থ।

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আফগানিস্তানে জ্বালানি রফতানি পুনরায় শুরু করা ইরান কিংবা বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়া পাকিস্তান, জি৭ এর এ ধরণের কোন পরিকল্পনায় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সাবেক ব্রিটিশ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্ক লায়াল গ্রান্ট বলেন, ‘আপনাকে ১৯৯৬ এর সাথে তুলনা করতে হবে যখন মাত্র তিনটি দেশ পাঁচ বছরের জন্য তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘এই সময়টা খুব আলাদা হবে: সব প্রতিবেশী সহ কোন বড় শর্ত ছাড়াই তালেবান শাসনকে অবিলম্বে ৫০ টিরও বেশি দেশ স্বীকৃতি দিতে পারে।’ হতাশ বরিস জনসন নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘যদি কোনো দেশ নিজে তা করতে রাজি না হয়, তাহলে পশ্চিমা শক্তির পক্ষে কোনো দেশের ওপর এই ধরণের আদেশ চাপিয়ে দেয়া খুব কঠিন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *